সমস্ত লেখাগুলি

বিক্রমপুর কেন অগ্রসর? -
মজিব রহমান
Nov. 21, 2024 | সচেতনতা | views:2571 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অগ্রসর এলাকা হিসেবে বিক্রমপুরের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। লর্ড কারমাইকেলের চোখে বিক্রমপুর ছিল স্কটল্যান্ডের মতো। লর্ড কার্জন বিক্রমপুরবাসীর কর্মদক্ষতা সম্পর্কে বেশ অবগত ছিলেন বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেছিলেন, এডিনবরা যেমন ইউরোপের মধ্যে তেমনি বিক্রমপুর ভারতবর্ষের মধ্যে সেরা। ইংল্যান্ডের এডিনবারর সাথে বিক্রমপুরের তুলনা হতো দক্ষ প্রশাসকসহ খ্যাতিমান মানুষদের জন্মস্থান হিসেবেই। কিন্তু কোন কোন মানুষদের কারণে এগিয়ে গিয়েছিল বিক্রমপুর? সেই অনুসন্ধান করে বিস্মিতই হয়েছি। মূলত বিক্রমপুরের মানুষেরা ছিল বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তায় অগ্রসর। আমার মনে হয়েছে ভারতের যে কোন অঞ্চলের চেয়ে বিক্রমপুরের মানুষ প্রগতিশীল। শুধু এ কারণেই বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় মৌলবাদীরা একযোগে বোমা হামলা করতে পারলেও একমাত্র মুন্সিগঞ্জে পারেনি। কলকাতা কেন্দ্রিক যে নবজাগরণ তৈরি হচ্ছিল তার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বিক্রমপুরের মানুষেরাই। যখন ব্রাহ্ম ধর্ম তৈরি হল তার নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে৷

জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী রাঢ়ীখালের স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কোন ধর্মীয় অনুরাগ ছিল না। তাঁর স্ত্রী তেলিরবাগ গ্রামের অবলা বসু ছিলেন কলকাতার অন্যতম সেরা সমাজসংস্কারকদের একজন। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণে অবলা বসু ও তাঁর ভাই বাংলার এটর্নি জেনারেল সতীশরঞ্জন দাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সতীশরঞ্জন দাশ গলার টনসিল অপারেশনের জন্য ১২ বছর বয়সে বিলেত গিয়ে সেখানেই পড়াশোনা করে ব্যারিস্টার হয়ে আরো ১২ বছর পরে দেশে ফিরেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা আইনজীবী। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হাঁসাড়া গ্রামের সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পিতা ব্যারিস্টার সুধীর রায় ছিলেন তাঁর জুনিয়র। তিনি ইংরেজদের ধাচে জীবন যাপন করতেন। তিনি বৃটিশদের ধাঁচে ভারতে দ্য দুন আবাসিক পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনো ভারতের অন্যতম সেরা স্কুল। এই দুন স্কুলে বিক্রমপুরের অবদান নিয়েই একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করা যায়। ভারতের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতিতে এই স্কুলের প্রাক্তণ ছাত্রদের বিশেষ অবদান রয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. রাজীব গান্ধীও ছিলেন দুন স্কুলের ছাত্র। এমনকি তার প্রশাসনে এই স্কুলের ছাত্রদের প্রাধান্য থাকায় একে ‘দুন মন্ত্রিপরিষদ’ও বলা হতো। ভারতের প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুজন সাহিত্যিক বিক্রম শেঠ ও অভিতাভ ঘোষ, প্রখ্যাত শিল্পী অনিশ কাপুরসহ অসংখ্য কৃতীসন্তান রয়েছেন এ স্কুলের ছাত্র। সতীশরঞ্জনের এক নাতি শমী দাশও এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁর বোন সরলা রায় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর স্বামী দার্শনিক প্রসন্নকুমার রায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় প্রিন্সিপাল ছিলেন।


এই পরিবারটির অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে কলকাতা বিনির্মাণে। সতীশরঞ্জন দাশের পিতার নাম দুর্গামোহন দাস।  তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। যদিও তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। দুর্গামোহন স্ত্রীর মৃত্যুর পরে বিখ্যাত সঙ্গীতস্রষ্টা অতুলপ্রসাদ সেনের বিধবা মা হেমন্তশী সেনকে বিবাহ করেন। তখন ভারতে হিন্দু বিধবাদের বিবাহের জন্য প্রচেষ্টা চলছিল। তিনি আরেকটি বৈপ্লবিক কাজ করেন যা কলকাতায় আলোড়ন তুলে; তা হল- নিজের অল্পবয়স্কা বিধবা সৎমার বিবাহ দেন। এসব আলোচিত ঘটনা ঘটানো সহজ ছিল না। এই পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি সতীশরঞ্জন দাসের কাকা ভুবন মোহন দাশের ছেলে। ভারতের মুসলিমদের পিছিয়ে পড়া ও সমস্যা নিয়ে তিনিই চিন্তা করেছিলেন। মুসলিমদেরও প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আবুল কালাম আজাদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘দেশবন্ধু অকালে মারা না গেলে দেশে নতুন অবস্থা সৃষ্টি করতেন’। তিনি মৃত্যুবরণ না করলে ভারত বিভক্তি রদ হতো বলেও অনেকে মনে করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকার্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।

 

পর্ব ২


চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবার শিক্ষিত প্রগতিশীল হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। তাঁর পিতা কলকাতা হাইকোর্টের এটর্নী ছাড়াও ‘ব্রাহ্ম জনমত’ পত্রিকার সম্পাদক হওয়ায় কলকাতার সাংবাদিক জগতেও সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতামহও ছিলেন সরকারি আইনজীবী। তাদের পরিবারে তিনজন ছিলেন জজ ও বেশ কয়েকজন আইনজীবী ছিলেন। এই পরিবারের ব্যাপ্তী খুবই ব্যাপক। বিক্রমপুরের সেরা দুটি পরিবারের একটি দাশ পরিবার। সরলা দাশের নাতি রেণুকা রায় কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভারতের মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ভাই সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম প্রধান মার্শাল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বোন ও জাতিসংঘের প্রথম নারী সভাপতি বিজয়া লক্ষ্মী পণ্ডিতের ভাগ্নি শারদা মুখার্জীকে বিয়ে করেন। সে হিসেবে পরিবারটি নেহেরু/গান্ধী পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ভাই প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতীয় রেল বোর্ডের চেয়ারপারসন। তিনি কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি ভায়োলেটকে বিয়ে করেছিলেন। তার ছোটবোন নীতা সেনের মেয়ে গীতি সেন খ্যাতনামা শিল্প ইতিহাসবিদ। গীতি সেন বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত বলিউড চলচ্চিত্র পরিচালক মোজাফফর আলীকে।

ভারতের প্রধান বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশও তাদের পরিবারের একজন। তাঁর পুত্র সুরঞ্জন দাশ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন। ভারতের কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী সোনারং গ্রামের অশোক কুমার সেন তাঁর কন্যা অঞ্জনা দাশের স্বামী। অশোক কুমার সেনকে ছাড়া দীর্ঘকাল ভারতের আইনমন্ত্রীর পদে অন্য কাউকে ভাবাই যেতো না। অশোক সেন ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আসনটি ধরে রেখেছিলেন। পরে তিনি রাজ্যসভার সদস্যও হন। নেহেরু মন্ত্রী সভায় তিনি ১৯৫৭-৬৬ এবং রাজিব গান্ধীর মন্ত্রী সভায় ১৯৮৪-৮৭ আইন ও বিচার মন্ত্রী হন। এ ছাড়া তিনি যোগাযোগ, ইস্পাত ও খনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লোকসভার আসন জয়ের রেকর্ড রয়েছে এবং তিনি সাত প্রধানমন্ত্রীর সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশনেরও সভাপতি ছিলেন। তারই ভাই সুকুমার সেন ১৯২১ সালে আইসিএস কর্মকর্তা ও ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যসচিব হন। এ পদে থাকা অবস্থাতেই প্রেষণে ১৯৫০ সালে তাঁকে স্বাধীন ভারতের প্রথম ‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার’ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি অসামান্য দক্ষতার সাথে বিশাল ভারতের প্রথম দুটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৮ পর্যন্ত (চাকরিকাল) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইলেকশন কমিশনের সভাপতিরূপে সুদান ও নেপালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালন করে অভূতপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তাদের আরেক ভাই অমীয় কুমার সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগী, চিকিৎসক ও শ্রুতি লেখক ছিলেন। তাদের পিতা অক্ষয় কুমার সেনও ছিলেন ভারতের আইসিএস কর্মকর্তা ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

সোনারং এর সেন পারিবারও ভারতব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। এই পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রসর পরিবার। এ পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুরুষ হলেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জে কিন্তু অমর্ত্য সেনের জন্ম শান্তিনিকেতনে মাতামহ সোনারং গ্রামের ক্ষিতিমোহন সেনের ‘পর্ণকুটীরে’। অমর্ত্য সেনের পিতা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ক্ষিতিমোহন ছিলেন তিনি চম্বা রাজ্যের শিক্ষা সচিব। রবীন্দ্রনাথের আহবানে তিনি শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগদান করেন এবং বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ রূপে কর্মজীবন শেষ করেন। কিছুদিন তিনি বিশ্বভারতীর অস্থায়ী উপাচার্যের পদেও আসীন ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে বেশ কয়েকবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে ও ১৯২৪ সালে চীন ভ্রমণে সফরসঙ্গী হয়েছেন। তিনি মধ্যযুগের সন্তদের বাণী, বাউল সঙ্গীত ও সাধনতত্ত¡ নিয়ে গবেষণা ও সংগ্রহে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরের চেষ্টায় সংগৃহীত বিষয়সমূহ কয়েকটি গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তিনি বিশ্বভারতী নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের প্রধান উৎসাহদাতা ও সচিব ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রপ্রতিভার সম্যক রসজ্ঞ ও টীকাকার। তাঁর স্ত্রী কিরণবালা সেন শান্তি নিকেতন থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা শ্রেয়শী’র সম্পাদক ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র ক্ষেমেন্দ্র মোহন সেন রবীন্দ্র সংস্কৃতির প্রচারক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা অমিতা সেনের পুত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনের কন্যা লেখক ও অভিনেত্রী নন্দনা সেনের স্বামী প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইনের চেয়ারম্যান ও সিইও জন ম্যাকিনসন। অমর্ত্য সেনের স্ত্রী নবনীতা দেবসেন পদ্মশ্রী প্রাপ্ত ভারতের একজন কবি, লেখক ও শিক্ষাবিদ।  উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা লেখক সত্যেন সেন ও রাষ্ট্রদূত বিনয় রঞ্জন সেনও এই পরিবারের সন্তান। বিনয় রঞ্জন সেন ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এশিয়ার প্রথম মহা পরিচালক। সত্যেন সেন সাংবাদিক ও লেখক হিসেবেও খ্যাতিমান। তাঁর পিতা প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করতেন এবং এ বিষয়ে পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর ঠাকুরদা ডাক্তার ভুবনমোহন সেন এর ছেলে ক্ষিতিমোহন সেন। সত্যেন সেনের ছোট ঠাকুরদা সংস্কৃতের শিক্ষক ও সংস্কৃত ভাষার কবি ছিলেন। আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশু সাহিত্যিক।


পর্ব ৩


চিত্তরঞ্জন দাশ জাত-পাত বৈষম্য মানতেন না৷ বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ পছন্দ না করে, নারীমুক্তি সমর্থন করে, নারীশিক্ষা ও বিধবাদের পুনর্বিবাহকে উৎসাহিত করতেন৷ শুধু মুখে নয়, তিনি অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে থেকে নিজ কন্যাদের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারে বিবাহ দিয়েছেন৷

ব্যারিস্ট্রার সুধীর রায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জুনিয়র হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনিও দেশবন্ধুর সাথে কংগ্রেসের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী একজন সদস্য। দেশবন্ধুর চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। তাদেরই পুত্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। এই রায় বংশের চন্দ্রশেখর রায়ের নামেই শেখরনগরের নামকরণ। এই পরিবারের রায়বাহাদুর শ্রীনাথ রায়ের নামে ওখানে একটি হাইস্কুল রয়েছে। তাঁরই আমন্ত্রণে ১৯১৫ সালে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এসে শেখরনগর ও হাঁসাড়ায় দুটি দাতব্য চিকিৎসালয় উদ্বোধন করেন। বিক্রমপুরের দাশ, সেন ও রায় পরিবারের মধ্যে একটি আত্মীয়তার বন্ধনও তৈরি হয়েছিল। বিক্রমপুরের অধ্যাপক শাহজাহান মিয়ার পরিবার আরেকটি অগ্রসর পরিবার৷ এ পরিবারের সুসন্তানরা খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ ও হিন্দু পরিবারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷

বিক্রমপুরের আরেকটি বিখ্যাত পরিবার মালখানগরের বসু পরিবার। এই পরিবারের সন্তান ত্রিশ দশকের বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসু। তাঁর কবিতায় বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এসেছে বারবারই৷ তাঁর কবিতায় রয়েছে— প্রেমের শরীরী সৌন্দর্যতা ও কামনার মুক্তি লাভের ব্যাকুলতা৷ তিনি বিয়ে করেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও ঔপন্যাসিক হাঁসাড়া গ্রামের রানু সোম (প্রতিভা বসু) কে। বিক্রমপুর জুড়ে অনেক বসু পরিবার ছিল। তারমধ্যে শ্রীনগরের লালা কীর্ত্তিনারায়ন বসু শ্রীনগরের জমিদার ও মীর কাশিমের গভর্নর ছিলেন। রাজানগরের সমরেশ বসু ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনিও তীব্র প্রগতিশীল ও মুক্তমনা ছিলেন৷ মাত্র ১৮ বছর বয়েসে প্রেম করে বিয়ে করেন বন্ধুর স্বামী পরিত্যাক্তা ২২ বছরের বোনকে৷ তাঁর রচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামহা হয়েছিল৷ লেখক খ্যাতি রয়েছে হালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী পূরবী বসুরও। পূরবী বসুর স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছোটগল্পকার। পুরবী বসু স্বামীর 'দত্ত' পদবী গ্রহণ করেননি৷ মুন্সিগঞ্জ শহরের পূরবী বসুদের প্রতিবেশি বিমান বসু পশ্চিমবঙ্গ বাম ফ্রন্টের চেয়ারম্যান। তাঁর ভাই তুষারকান্তি বসু ছত্রিশগড় থেকে প্রকাশিত দণ্ডকারণ্য সমাচার নামে একটি দৈনিক হিন্দি পত্রিকা প্রকাশ করে এর প্রধান সম্পাদক হন। কবি ও শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল বসুর পরিবারটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুকোমল বসু ও বোন মঞ্জুলিকার পুত্র সুসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। বুদ্ধদের গুহর বাবলি উপন্যাসের বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল৷ সাহিত্যিক-সাংবাদিক গিরিশচন্দ্র বসু তাঁর পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন তাঁর মাতামহ। গিরিশচন্দ্র বসু নদীয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দারোগাগিরিরি অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেন ‘সেকালের দারোগা কাহিনী’। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্র জগতের অগ্রদূত ছিলেন। ১৮৪৬ সালে সাপ্তাহিক হিন্দু ইন্টেইলজেন্সার পত্রিকা প্রকাশ করেন। বঙ্গদেশে এটা ছিল সর্বপ্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র এবং এটিতেই সবার আগে রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনা হয়েছিল। বিচারপতি চন্দ্র মাধব ঘোষ, ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ ও ব্যারিস্টার লালমোহন ঘোষ তাঁর মামাতো ভাই।

চন্দ্র মাধব ঘোষ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম বাঙালি বিচারপতি এবং পরবর্তীতে তিনি প্রধান বিচারপতিও হন। চন্দ্র মাধব ঘোষের পিতা ছিলেন বাংলার ডেপুটি কালেক্টরদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেন। চন্দ্র মাধবের বড় পুত্র এডভোকেট যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ রায়বাহাদুর হয়েছিলেন। চন্দ্র মাধব ঘোষের আরেক পুত্র সতীশচন্দ্র ঘোষও ছিলেন নামকরা উকিল। তাঁর ছেলে অরুণকুমার ঘোষও বার-অ্যাট ল। চন্দ্রমাধবের এক দৌহিত্র অশোককুমার রায়ও ছিলেন ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের পিতা রামলোচন ঘোষ প্রথম ব্যাচের ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষিত কর্মকর্তা ও সমাজ-সংস্কারক, কৃষ্ণনগরের সদর-অলা, ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ও মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। মনোমোহনই প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার হিসেবে ১৮৬৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে প্রচুর ভূমিকা রাখেন। বেথুন কলেজের সুপারিনটেন্ডেন্ট রূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী ও ঘণিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর ছোটভাই অসাধারণ বাগ্মী লালমোহন ঘোষ ১৮৮০ সালে ব্যারিস্টার হন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য ইংরেজি অনুবাদ করেন, ১৯০৫ সালে তিনি জাতীয় মহা সমিতির সভাপতি হন এবং তিনিই কংগ্রেস নেতা হিসেবে সর্বপ্রথম বাঙ্গালিকে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ঘোষ পদবীধারীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের বিদ্যাসাগরখ্যাত কালীপ্রসন্ন ঘোষ লেখক, সম্পাদক ও ভাওয়াল রাজার দেওয়ান হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কুমারভোগ গ্রামের বিখ্যাত বিপ্লবী মার্ক্সশিস্ট জিতেন ঘোষ লেখক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বহর গ্রামের সুবোধ ঘোষও লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। শ্রীনগরের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সিনেমা নির্মাতা ও ওষুধ ব্যবসায়ী। তারা সকলেই প্রগতিশীল মানুষ৷


পর্ব ৪


কনকসার গ্রামের সরোজিনী নাইডুর পরিবারও বিখ্যাত পরিবার। তাঁর পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ— ছিলেন হায়দরাবাদের নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। সরোজিনীর মা ছিলেন বাংলা ভাষার একজন অগ্রগণ্য কবি। তাঁর ভাইদের মধ্যে বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিন কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং হিন্দু-জার্মান যড়যন্ত্রের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব যাকে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ হত্যা করে। সরোজিনীর ছোট বোন মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অধ্যয়ন করেন স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন ও ট্রাইপস লাভ করেন। মৃণালিনীও একমাত্র ভারতীয় নারী হিসেবে জার্মানিতে গিয়ে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন৷  তাঁর অপর ভাই হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা। সরোজিনী ব্রাহ্মণ কন্যা হলেও মাত্র ১৭ বছর বয়সে অব্রাহ্মণ ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে অসবর্ণ বিয়ে করে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে এক কন্যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী পদ্মজা নাইডু পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছিলেন।

শ্যামসিদ্ধি গ্রামের হরি আনন্দ বাড়রীও হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল ছিলেন। তিনি অবশ্য ভারতের গোয়েন্দা পুলিশ প্রধানও ছিলেন। তাঁর কন্যা রাধারানীর স্বামী কনকসার গ্রামের পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং পরবর্তী কালে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হন। বর্তমানে তিনি ভারতের বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো। বিক্রমপুরের আরো অনেকেই রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। আমিনুর রহমান শামসুদ দোহা যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, ইরান ও তুরস্কর রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর পিতা শরিষাবন গ্রামের আবু হামিদ মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা প্রথম ভারতীয় হিসেবে ডেপুটি কমিশনার হন। ভারত ভাগের পরে প্রথম মুসলিম হিসেবে ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ পুলিশের আইজি হন। এরপর আইয়ুব খান সরকারের কেন্দ্রীয় খাদ্য, কৃষি ও পূর্ব দপ্তরের মন্ত্রী হন। সিদ্ধার্থ শংকর রায়ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও বাহমার হাইকমিশনার ছিলেন। ষোলঘরের কামরুদ্দিন আহমদ বার্মার রাষ্ট্রদূত এবং কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। সোনারং গ্রামের বিনয় রঞ্জন সেন আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রথম ভারতীয় মহাপরিচালক ছিলেন। বিএনপির মন্ত্রী এম. শামসুল ইসলাম ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরা সকলেই মননে ও চেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল।

সিরাজদিখানের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলায় শীর্ষস্থানীয়। তিনি আন্তর্জাতিক ফ্যামে কাজ করার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তীব্রভাবেই মার্ক্সশিস্ট ও বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর লেখাতেও সাধারণ মানুষের জীবন উঠে এসেছে। তীব্র প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন শ্রীনগরের ড. হুমায়ুন আজাদও। আহমদ শরীফের পরে তিনিই প্রগতিশীলতার পক্ষে লিখছিলেন জোরালোভাবেই। কিন্তু মৌলবাদী অপশক্তি তাকে হত্যা করে। তবে শ্রীনগরের লেখক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরেকজন দেশবরেণ্য প্রগতিশীল লেখক। লৌহজং এর ইমদাদুল হক মিলনও ঔপন্যাসিক হিসেবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সিলেটে মৌলবাদীদের হাতে নিহত নুরজাহানকে তুলে আনেন বিক্রমপুরের প্রেক্ষিতে এবং মৌলবাদীদের অপরাধের একটি দলিল রচনা করেন। শ্রীনগরের ফয়েজ আহমেদ প্রসিদ্ধ ছড়াকার হলেও তিনি পত্রিকায় কলাম লিখেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রগতিশীল আন্দোলনের সারাদেশেরই শীর্ষস্থানীয় একজন। তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের আওতায় আনার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন এবং তাদের একটি নমুনা বিচারের তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন। লৌহজং এর নূহ-উল-আলম লেনিন প্রগতিশীল রাজনীতি করে এসেছেন। তিনিও গবেষক ও লেখক হিসেবে প্রগতির পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে গবেষণাও করেছেন।


পর্ব ৫


সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাধারণত প্রগতিশীল মানুষই থাকেন। দেশবরেণ্য দুজন নৃত্যশিল্পীর দুজনেরই বাড়ি বিক্রমপুরে। সিরাজদিখানের গওহর জামিল যিনি রওশন জামিলকে বিয়ে করার জন্য গণেশ নাগ থেকে ধর্মান্তরিত হলেও তিনি কখনোই প্রগতিশীলতা ছাড়েননি। তিনি বাংলাদেশের নৃত্য শিল্পের একজন পথিকৃৎ। দেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা যেমন আব্দুল জব্বার খান, শিশুশিল্পী তাঁরই পুত্র মাস্টার জুলু তেমনি প্রথম নৃত্য পরিচালকও বিক্রমপুরের— গওহর জামিল৷ সেই পথ ধরেই টঙ্গিবাড়ির লায়লা হাসান রোজি হয়ে উঠেন নৃত্যশিল্পের আরেক দিকপাল। তাঁর স্বামী হাসান ইমামও একজন বরেণ্য সাংস্কৃতিক কর্মী যিনি পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চা বন্ধের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। চারণ কবি মুকুন্দু দাশ, ‘একবার যেতে দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পড়বে ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এ গান ব্রিটিশদের বুক কাঁপিয়ে দিতো৷ হালে শাহ আলম সরকার বাউল শিল্পী হিসেবে দেশবরেণ্য হয়ে উঠেন। তাঁর পালাগান সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে ভূমিকা রাখে। তাঁর গান গেয়েই শিল্পী মমতাজ খ্যাতি লাভ করেন। সংগীত শিল্পী হিসেবে ভারতজোড়ে খ্যাতি লাভ করেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও হালের শ্রেয়া ঘোষাল। শ্রীনগরের শিমুল ইউসুফ ও তাঁর স্বামী নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। শিমুল ইউসুফ গান ও অভিনয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন।

সব ধরনের সঙ্গীতেই বিক্রমপুরের মানুষের বিশেষ অবদান রয়েছে। লোক সংগীত, পালাগান, আধুনিক গান সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান অনেক। বাউল শিল্পীদের মধ্যে আরো ছিলেন আবুল সরকার,  যিনি সারাদেশেই খ্যাতি অর্জন করেন। মুকুন্দু দাস ও কালাচাঁদ দাস কুন্ডু কীর্তন পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। শ্যামসিদ্ধি গ্রামের নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সব ধরনের গান করলেও কীর্তনীয়া হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি প্লে-ব্যাক সিঙ্গারও ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখেছেন সংগীত শিল্পী মালখানগরের উমা বসু ও হাঁসাড়ার প্রতিভা বসু। প্রতিভা বসু নজরুলেও ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মাহাত্মা গান্ধী উমাকে নাইটিংগেল উপাধি দেন। সীমান্ত গান্ধী খ্যাত খান আব্দুল গফফার খান ও সুভাষচন্দ্র বসু উমার গানের ভক্ত ছিলেন।  সন্তোষ সেনগুপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ভারত সরকারের গীতশ্রী উপাধী প্রাপ্ত সাবিত্রী ঘোষ বহু সিনেমাতেও কণ্ঠ দিয়েছেন। লৌহজং এর বাহেরক গ্রামের মেয়ে কলকাতার আধুনিক গানের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি’, ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’ এর মতো গান তিনি গেয়েছেন। টঙ্গিবাড়ির মুজিব পরদেশি ও মুন্সিগঞ্জ সদরের জহির আহমেদ সারাদেশব্যাপীই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন৷ তাদের গান এখনো সংগীতপিপাসুরা পছন্দ করেন৷ শিমুল ইউসুফ শুরুতে খ্যাতি অর্জন করেন গান গেয়েই। পরবর্তীতে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেই খ্যাতি পান। অভিনয় জগতে সবচেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন নায়িকা হিসেবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে টেলি সামাদ ও নারায়ণ চক্রবর্তী খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া নাজমা আনোয়ার, আব্দুল জব্বার খান, দোয়েল, আব্দুল কাদের খ্যাতিমান ছিলেন। পপ সংগীতের অন্যতম গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ নায়ক হিসেবেও অভিনয় করেন। তাঁর পুত্র হাবিব ওয়াহিদও খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। এ সময়ের বালাম ও তাহসানও বিক্রমপুরের। তাহসান অভিনয় করেও খ্যাতি অর্জন করেন। সিনেমা পরিচালনাতেও আলোচিতদের কয়েকজন হলেন আব্দুল জব্বার খান, চাষী নজরুল ইসলাম, আলমগীর কুমকুম, শফী বিক্রমপুর, নুর হোসেন বলাই। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন আলাউদ্দিন আলী ও সরদার আলাউদ্দিন আহমেদ।

চলচ্চিত্র অঙ্গনেও বিক্রমপুরের মানুষের বিপুল অবদান রয়েছে। আবদুল জব্বার খানকে বাংলা চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। তিনি মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ঢাকায় এর দুয়ার খুলে দেন। স্বাধীনতার পরে পরিচালক হিসেবে আসেন চাষী নজরুল ইসলাম। তাঁর ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। আলমগীর কুমকুম ও নুর হোসেন বলাইসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক বিক্রমপুরের। অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ জনপ্রিয় অভিনেত্রী৷ উত্তম কুমারের সাথে তাঁর জুটি বহু হিট সিনেমা উপহার দিয়েছে৷  আলাউদ্দিন আলী ও শাহ আলম সরকার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ নামের সিনেমা করে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবদান রাখেন। প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও ভূমিকা রাখেন।

চিত্র শিল্পে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন সারদা উকিল, বরোদা উকিল, রণদা উকিল, শান্তনু উকিল, মুকুল দে, আব্দুল হাই, অতুল চন্দ্র বসু, কাজী আব্দুল বাসেতসহ অনেকে। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনটাও বিক্রমপুরের মানুষ আলোকিত করে রেখেছেন৷ তাদের প্রগতিশীলতার আলোয় আলোকিত হয়েছে ঢাকা থেকে কলকাতা তথা সারা বাংলা!

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929